সেও ভালোবাসে

#১ম_পর্ব

 

অবিবাহিত হলেও আমার বিছানায় আমার পাশেই কোনো এক মেয়ের উপস্থিতি বেশ কয়েকদিন যাবত উপলব্ধি করছি। মাঝরাতে মেয়েলি চুলের ঘ্রাণ ভেসে আসে আমার নাকে। আমি চোখ খোলার সাহস পাই না, তবে চোখ বুজে বলে দিতে পারি, এই ঘ্রাণটা একজন মেয়ের চুলের ঘ্রাণ। পাশাপাশি বালিশ থাকলে পাশের মানুষটার চুলের ঘ্রাণ নাকে আসবে এটাই স্বাভাবিক। তবে এই ঘ্রাণটা যেকোনো পুরুষকে পাগল করে দিতে পারবে তা আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি। প্রথম-প্রথম এটাকে আমি স্বপ্ন বলে ধরে নিতাম, তবে পরবর্তীতে ব্যাপারটা আমার কাছে ধীরেধীরে খোলাসা হতে থাকে৷

ফজরের আজান কানে ভেসে আসতেই একপ্রকার ধরফরিয়ে উঠে বসে পড়ি আমি৷ কেউ একজন আমার মুখের খুব কাছে এসেছিলো। তার নাকের গরম শ্বাস প্রতিবার আমার মুখে পড়ছিল। কেন জানি অনুভূতিটা অসাধারণ লাগছিলো। কী সেই অনুভূতি যার সংস্পর্শে আমার মনে সুখের ঢেউ প্রবাহিত হয়! অনুভূতিটাকে দেখার খুব ইচ্ছে চেপে বসে মাথায়। কোনোমতে চোখ খুলতে অথবা শোয়া থেকে উঠতে পারছিলাম না। তবে ফজরের আজান কানে আসতেই একপ্রকার ধরফরিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসি আমি। বা’দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম পাশে কেউ আছে কি না। নাহ, কেউ নেই। সারা রুমে চোখ বুলালাম খানিক্ষণ, তেমন কিছুই ধরা পড়লো না চোখে। একটা খাটে আমি একজন একা ঘুমালেও দুটো বালিশ থাকে সবসময়। হঠাৎ পাশে থাকা বালিশটায় চোখ যেতে চমকে গেলাম আমি। সাদা কভারে আবৃত বালিশটা কিছুটা কালচে রং ধারণ করেছে। দেখে মনে হচ্ছে কেশে নিয়মিত তেল দেয়া কেউ একজন সবসময় ঘুমায় এই বালিশটায়। আরও চমকে যাই, যখন বালিশের আশেপাশে কয়েকটা লম্বা গাঢ় রেশমি চুল আমার চোখে পড়ে। থমে যাই আমি। তাহলে কারোর উপস্থিতিকে আমি স্বপ্ন মনে করতাম, এটা ভুল! বাস্তবেই কি আমার সাথে ঘটছে এসব!

সকাল হতেই বাহিরে মানুষের কোলাহল শুনতে পেয়ে বাসা থেকে বের হওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম৷ আম্মু আমাকে উদ্দেশ্যে করে বলল, ” সজীব, অরুদের বাসায় পুলিশ এসেছে৷ তুই কোনো ঝামেলায় জড়াস না কিন্তু। ”
আমি কিছু বললাম না, মুচকি হাসলাম মাত্র। তারপর বেরিয়ে পড়লাম বাসা থেকে।

চারদিন হলো আরুকে খুন করা হয়েছে৷ তার নাম অরুণিমা। সবাই সংক্ষেপে অরু বলে ডাকত। তবে আমি তার নামে একটা আকার বাড়িয়ে দিয়েছিলাম, তাকে আরু নামে ডাকতে ভালো লাগত আমার। চারদিন আগে তাকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছিল। আরুদের বাসা উঠোনে যেতেই লক্ষ্য করলাম বাহিরে কয়েকজন পুলিশ বসে আছে৷ বারান্দার ফ্লোরে বসে আছেন কাদের চাচা। আরু কাদের চাচার মেয়ে।
অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে এলাকার কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তি আসলেন৷ পুলিশ অফিসার তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ” ডিএনএ টেষ্ট করে জানা গেছে চারজন পুরুষ পালাক্রমে ধর্ষণ করেছিলো মেয়েটাকে। ”
বসে থাকা সবাই একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে, কেউ কিছু বলছে না৷ তখন এলাকার চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান চাচা বললেন, ” আসামীদের কি কোনো খোঁজ পাওয়া গিয়েছে? ”
অফিসার বললেন, ” খুনটা যেহেতু এই এলাকায় হয়েছে, খুনিরাও অবশ্য এখানকার অথবা আশপাশের হবে৷ ”
উঠোনে বসে সবাই কথা বলছে, তাদের কথা এতক্ষণ কান পেতে শুনছিলাম। তাদের কথা শোনা বাদ দিয়ে কাদের চাচার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। এলাকার কয়েকজন রসিকবাজ ব্যক্তিদের মধ্যে কাদের চাচা একজন। উনার সাথে কথা বললে সিরিয়াস মূহুর্তেও কেউ না হেসে পারবে না। অথচ মেয়ে হারানোর শোকে তিনি প্রায় পাথর হয়ে গিয়েছেন এখন৷ আমাকে উনার পাশে দেখতে পেয়ে চোখ দুটোকে রাঙ্গিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ” তুই যাবি এখান থেকে? ”
আমি কিছু না বলে চলে আসলাম সেখান থেকে৷ এমনিতেই এই ক’দিন ধরে কেন জানি আমাকে দুই নয়নে দেখতে পারছেন না কাদের চাচা৷ পুলিশদের সামনে যদি উল্টাপাল্টা কিছু করে বসে সেই ভয়ে আমি চলে আসলাম সেখান থেকে৷

আরু খুন হবার পর পুলিশ তদন্ত করতে এসে আরুদের বাসার কাছের জাম গাছটার গোড়ায় একটা দড়ি পায়৷ সেই দড়িটা আরুর রুমে কাপড় টানানোর জন্য ব্যবহার করা হতো, তাই লোকজন নিঃসন্দেহে বলছে, ” মেয়েটা ফাঁসি দেয়ার উদ্দেশ্যে মাঝরাতে ঘর থেকে বের হয়েছিলো৷ ”
আরুদের বাসার ঠিক পশ্চিমে একটা সরু রাস্তা, শুধুমাত্র এলাকার লোকজনদের চলাচলের জন্য। রাস্তার ঠিক পশ্চিমে আমাদের বাসা৷ বাসা পাশাপাশি হওয়ায় আমাদের মধ্যে বেশ স্বজনপ্রীতি বিদ্যমান। আরুদের বাসা থেকে প্রায় পঞ্চাশ ফিট দক্ষিণে রাস্তার পাশেই আরুর ধর্ষণ হওয়া ক্ষত-বিক্ষত দেহ পাওয়া গিয়েছিল৷ ফর্সা গাল দুটোতে ধারালো নখের আঁচড়, গায়ে থাকা জামাটা বিভিন্ন দিক থেকে ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল। পুলিশ আশেপাশের সবকিছু ভালো করে খুঁজেও আর কিছুর সন্ধান পায়নি৷

সজীব থেমে যায়। উপরের কথাগুলো সজীবের ঘনিষ্ঠ বন্ধু বাধনকে উদ্দেশ্য করে বলছিলো এতক্ষণ। বাধন আজকেই চট্টগ্রাম থেকে এসেছে। যদিও পাশে বসে দিপুও সব শুনছে, তবে সব ঘটনা তার পুরোপুরি জানা। সজীব কিছুক্ষণ চুপ থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে৷ তখন দরজায় “খটখট” শব্দ হয়৷ সজীব বলে উঠে, ” কে? ”
দরজার ওপাশ থেকে আওয়াজ আসে, ” পিঠা বানিয়েছি, নিয়ে যা। ”
সজীব কিছু না বলে পিঠা নিয়ে আসে বন্ধুদের খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে।

বাধন একটা পাক্বান পিঠা হাতে নিয়ে সেটার কিছু অংশ মুখে নিয়ে চিবুতে-চিবুতে বলে, ” আচ্ছা, কাদের চাচা তোকে দেখতে পারছে না কেন? আগে তো তোর সাথেই উনার সখ্যতা বেশি ছিলো! ”
সজীব উত্তর দেয়, ” সেই কারণটা আজও আমার অজানা৷ ওইদিন সকালে আরুদের বাসায় কান্নার আওয়াজ শুনে একপ্রকার দৌঁড়ে ওখানে যাই৷ লোকের মুখে শুনতে পাই, আরুকে কে বা কারা ধর্ষণ করার পর খুন করে রাস্তার পাশে ফেলে গেছে৷ আমি কাদের চাচার কাছে উনাকে শান্তনা দেয়ার উদ্দেশ্যে গিয়েছিলাম৷ আমাকে দেখেই উনার চোখ দুটো লাল করে আমাকে বলেন, তুই আমার সামনে কখনো আসবি না আর৷ সবকিছুর জন্য তুই দায়ী৷ ”
বাধন আবারও প্রশ্ন করে, ” তুই কি কোনোরকমে আরুর খুনের সাথে জড়িত? ”
সজীব উত্তর দেয় না। পাশে বসা দিপু বলে উঠে, ” সজীব আরুকে পছন্দ করতো৷ ”
সজীব এবার মুখ খুলে৷ সে বলে, ” শুধু পছন্দ করতাম না, অনেক ভালোও বাসতাম৷ ”
বাধনের মাথায় আরও বহু প্রশ্ন জেগে উঠতেছে৷ বাধন প্রশ্ন করে, ” তাহলে কাদের চাচা কি তোর ভালোবাসার ব্যাপারটা জেনে গিয়েছিলো? ”
সজীব উত্তর দেয়, ” ভালোবাসার কথা আরুকেও বলিনি কখনো, কাদের চাচা তো দূরের কথা৷ ”
বাধন উত্তেজনার সাথে আবারও প্রশ্ন করে, ” তাহলে চাচা তোকে দু’চোখে দেখতে পারছে না কেন? ”
” উত্তরটা আমারও অজানা। ” নিচুস্বরে বলে সজীব।
অতঃপর সবার নীরবতা।

বাধন সজীবকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” বাদ দে এসব চিন্তা, যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে৷ তবে রাতে একটু সাবধানে থাকিস৷ ”
সজীব কিছু বলে না আর। বাধন এবার সজীবকে প্রশ্ন করে, ” আমি এখানে কেন এসেছি জানিস? ”
সজীব জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায় বাধনের দিকে, কারণ প্রশ্নের উত্তরটা তার অজানা। তখন দিপু বলে উঠে, ” তুই তোর লাইলীর জন্য এসেছিস৷ হিহিহি। ” হাসতে থাকে দিপু।
” আজ রাতে আমি আর বিন্দু পালিয়ে যাবো। ”
বাধনের মুখে এমন কথা শুনে মুখে থাকা পিঠার অংশ মুখেই থেকে যায় দিপুর৷
” এ তুই কী বলছিস? বিন্দুর ভাই এলাকার কুখ্যাত একজন মাস্তান। তোকে ধরতে পারলে কেটে টুকরো-টুকরো করে গোমতীর পানিতে ভাসাবে৷ ”
দিপু বাধনকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলছে৷ বাধন এসবের তোয়াক্কা না করে আবারও বলে, ” আজ রাতে আমরা বিয়ে করছি, তুই আর সজীব সাক্ষী থাকবি আমাদের বিয়েতে৷ ”
বাধনের কথা শুনে দিপু গ্লাসে পানি না নিয়ে জগটা হাতে নিয়ে “গড়গড়” আওয়াজে মুখে পানি ঢালতে থাকে৷
সজীব এবার মুখ খুলে। সে বাধনকে প্রশ্ন করে, ” আগে দেখ পারিবারিকভাবে তোদের মেনে নেয় কি না! ”
বাধন সোজা কথায় উত্তর দেয়, ” বিন্দুর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে৷ আমাকে মেনে নিবে না তার পরিবার। পরশু বৃহস্পতিবার-ই তার বিয়ে৷ ”
সজীব বলে, ” তাহলে ঠিক আছে৷ তা কোথায় বিয়ে করছিস? ”
বাধন উত্তরে দেয়, ” পাশের এলাকার বন্ধন কাজী অফিসে৷ কাজীর সাথে কথা বলে রেখেছি৷”
” তাহলে আজ রাতেই সব হয়ে যাবে৷ ”
সজীব বাধনকে উদ্দেশ্য করে বলে৷ দিপুও আর কথা বাড়ায় না।

রাত এগারোটা।
সজীব আর দিপু তাদের এলাকার সীমানা পেরিয়ে পাশের এলাকায় অবস্থান করলো, পিঁছুপিঁছু বাধন আর বিন্দু৷ উদ্দেশ্য বন্ধন কাজী অফিস। সজীব বহুদিন এই পথে আসে না, তবুও তার মনে হচ্ছে এই রাস্তাটায় হেঁটেছে বেশিদিন হয়নি। অজানা এক ভয় ভীড় করেছে তার মনে৷ কাজী অফিসের সামনে আসতেই সাইনবোর্ডে তাকিয়ে কাজীর নাম লক্ষ্য করে সজীব, কাজী রহমত ভূইয়া। কাজী অফিসের দরজায় টোকা দিতেই ভেতর থেকে দরজা খুলে দাড়িতে লাল রং করা একজন বয়স্ক ব্যক্তি, দেখলেই বুঝা যায় উনি এখানকার কাজী। সজীব কাজী অফিসে আগে আর কখনো আসেনি, তবুও কেন জানি কাজী সাহেবকে সজীবের চেনা-চেনা লাগছে৷

ভেতরে গিয়ে সবাই চেয়ারে বসতেই কাজী সাহেব সজীব আর দিপুকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” এই! তোমরা কারা? ”
দিপু সহজ উত্তর দেয়, ” আমরা বাধনের বিয়েতে সাক্ষী হিসেবে এসেছি৷ ”
” না, আমি তোমাদেরকে গত শনিবার মাঝরাতে দেখেছি৷ গত শনিবার রাতে স্বপ্নের মাধ্যমে আমি তোমার আর একটা মেয়ের বিয়ে পড়িয়েছি। জীবনে বহুবার অনেক মানুষকে স্বপ্নে বিয়ে পড়িয়েছি আমি, তবে এই প্রথম স্বপ্নে বিয়ে পড়ানো মানুষকে সরাসরি দেখলাম৷ ”
সজীবের দিকে আঙ্গুল তুলে কথাগুলো বলে কাজী রহমত ভূইয়া। সজীব অবাক হয়ে যায়, তার ঠোঁট কাঁপতে থাকে। সজীব ভাবতে লাগল, তাহলে আরু খুন হওয়ার রাতে আমার দেখা স্বপ্নটা এই কাজীও দেখেছিলো? আর এই জন্যই কি এই গ্রামের রাস্তা, এই কাজী সাহেবকে চেনা-চেনা লাগছিলো আমার!
কাজী সাহেব আরেকজনের দিকে আঙ্গুল তুলে বলে, ” তুমি আর অন্য একটা ছেলে এই বিয়েতে সাক্ষী ছিলে। ”
এবার আঙ্গুল দিপুর দিকে।
দিপু সজীবকে উদ্দেশ্য করে অল্প আওয়াজে বলে, ” সজীব, তুই আমাকে খারাপ ভাবতে পারিস, এইজন্য কথাটা গোপন রেখেছিলাম। অরুণিমা খুন হওয়ার রাতে স্বপ্নে দেখেছিলাম, এই কাজী অফিসে তোর আর অরুর বিয়ে হয়েছে। আমি আর সুমন তোদের বিয়েতে সাক্ষী ছিলাম। ”

#চলবে

পরবর্তী পর্ব পেতে কমেন্ট করুন….

Leave a Comment